ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​বিবিসি বাংলা প্রতিবেদন

পাকিস্তানের করাচি থেকে আসা জাহাজটির কন্টেইনারে যা যা আছে

ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় : ১৭-১১-২০২৪ ১১:৪৪:৩৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ১৭-১১-২০২৪ ১২:৫৯:০৪ অপরাহ্ন
পাকিস্তানের করাচি থেকে আসা জাহাজটির কন্টেইনারে যা যা আছে প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ সরাসরি এসে ভিড়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে। গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও গণমাধ্যমে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

পাকিস্তানের করাচি থেকে ছেড়ে আসা 'এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং' নামের ওই জাহাজটি গত ১৩ই নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়েছিলো।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পণ্য খালাস হয়ে গেলে পরদিনই জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করেছে।

জানা গেছে, ‘দুবাই টু চট্টগ্রাম’ রুট ধরে আসা জাহাজটির পরবর্তী গন্তব্য ইন্দোনেশিয়া। নতুন এই সার্ভিসটি চালু করেছে দুবাই ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রশ্ন হল, এত বছর পর বাংলাদেশে পাকিস্তান থেকে কন্টেইনারবাহী জাহাজ কেন এল? কেন-ই বা এটি এত তাৎপর্যপূর্ণ? ওই কন্টেইনারগুলোতে কী আনা হয়েছে, তা নিয়েও মানুষের কৌতুহল কম না।

পাকিস্তান বাংলাদেশের বাণিজ্য
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বহু বছর দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য হতো না।

পরবর্তীতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হলেও পাকিস্তান থেকে সাধারণত সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসতো না। সেদেশের পণ্যবাহী জাহাজ প্রথমে শ্রীলঙ্কায় কন্টেইনার খালাস করতো। এরপর জাহাজ বদল করে সেসব কন্টেইনার বাংলাদেশে আসতো।

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দুই দেশের মাঝে শীতল সম্পর্ক ছিল।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সীমিত হতে থাকে। তখন নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা অধিকাংশ পণ্য “লাল তালিকাযুক্ত” করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের অনুরোধে গত ২৯শে সেপ্টেম্বর লাল তালিকা থেকে মুক্ত হয়েছে দেশটির সব ধরনের পণ্য।

শুরু এক্ষেত্রেই না, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে আরও অনেক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে অধ্যাপক ইউনুস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের মধ্যে বৈঠকের ঘোষণায়ও উল্লেখ করা হয় যে দুই দেশই বিভিন্ন স্তরে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করেছে।

এসবের মাঝে নতুন করে এই জাহাজ ভেড়ানোর খবর দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বাংলাদেশে পাকিস্তান হাই কমিশনও গত বুধবার তাদের ভেরিফায়েড এক্স (পূর্বের টুইটার) হ্যান্ডেলে এটিকে “দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

ওই টুইটে তারা বলেছে, এই “নতুন রুট সরবরাহ ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মাঝে আনবে, ট্রানজিট সময় কমিয়ে দেবে এবং উভয় দেশের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ খুলে দিবে।”

যদিও সামাজিক মাধ্যমে 'পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে' আসা বলে ব্যাপক আলোচনা হলেও, আসলে জাহাজটি দুবাই থেকে ইন্দোনেশিয়া যাবার পথে করাচি ও চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার লোড বা আনলোড করেছে।

জাহজটিতে করে কী আনা হয়েছে?
পাকিস্তান থেকে কন্টেইনারবাহী একটি জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশে আসার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর এ নিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেনন, ''আমাদের কাছে ৩৭০ টি কন্টেইনার আসছে। সেগুলোর মাঝে কী আছে, তা কাস্টমস বলতে পারবে।”

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''ফ্রেবিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট, ডলোমাইট আছে।''

এসব পণ্যের ওজন ছয় হাজার ৩৩৭ টন। এর মধ্যে ১১৫ কন্টেইনারে রয়েছে সোডা অ্যাশ। ডলোমাইট রয়েছে ৪৬টি কন্টেইনারে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কন্টেইনারগুলোর মধ্যে বেশিরভাই টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল। এর মধ্যে আরো আছে কাঁচ শিল্পের কাঁচামাল,গাড়ির যন্ত্রাংশ, রং, কাঁচামাল কাপড়। ৪২টি কন্টেইনারে রয়েছে পেঁয়াজ। ১৪টি কন্টেইনারে রয়েছে আলু।

এসব পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশের আকিজ গ্লাস কারখানা, প্যাসিফিক জিনস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, নাসির গ্লাস, এক্স সিরামিকস, হাফিজ করপোরেশন, এম আর ট্রেডিংস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান।

মোহাম্মদ সাইদুর রহমান জানান, সবগুলো কন্টেইনার করাচি থেকে জাহাজে লোড হয়নি। কিছু কন্টেইনার দুবাই থেকে জাহাজটিতে লোড করে বাংলাদেশে আনা হয়েছে।

পাকিস্তান থেকে জাহাজে লোড হয়েছে ২৯৭টি কন্টেইনার, বাকিগুলো লোড হয়েছে দুবাই থেকে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে খেজুর, মার্বেল ক্লক, কপার ওয়্যার, জিপসাম, লোহার টুকরো। একটি কন্টেইনারে অ্যালকোহল জাতীয় পণ্যও রয়েছে।

সাধারণত বড় কন্টেইনার বহনকারী জাহাজগুলোতে বিভিন্ন বন্দর থেকে মালামাল নামানো বা তোলা হয়ে থাকে। ফলে একটি জাহাজে বিভিন্ন দেশের বন্দর থেকে যেমন কন্টেইনার তোলা হয়, তেমনি বিভিন্ন দেশের বন্দর থেকে আপলোড করা কন্টেইনার তারা নির্দিষ্ট কোন বন্দরে নামিয়ে দিতে পারে।

এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত একটি বড় কন্টেইনারবাহী জাহাজে অন্তত সাতশো থেকে একহাজার কন্টেইনার বহন করে থাকে। ফলে কোন দেশের সাথে আরেকটি দেশের বড় আকারের বাণিজ্য না হলে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল করে না।

এক্ষেত্রে তৃতীয় কোন বন্দরে জাহাজ বদল করে অথবা অন্য আরো দেশের পণ্যের সাথে জাহাজে কন্টেইনার পরিবহন করা হয়ে থাকে।

যেমন এখন চীন থেকে সরাসরি কন্টেইনার নিয়ে বাংলাদেশে জাহাজ আসে। জাপান থেকেও কখনো কখনো জাহাজ আসে। কয়েক বছর আগে ভারতের চেন্নাই বন্দর থেকেও মালামাল নিয়ে জাহাজ ভিড়তো।

এর বাইরে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা নিয়ে বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল বা গ্যাস নিয়ে জাহাজ সরাসরি আসে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলছেন, পাকিস্তান থেকে খোলাভাবে পণ্য আগেও আসতো, এখনও আসে। সেগুলো তৃতীয় দেশের বন্দরে নামানোর পর জাহাজ বদল করে বাংলাদেশে আসে।

কিন্তু পাকিস্তান থেকে সরাসরি “কন্টেইনারে করে এই প্রথম এসেছে। এগুলো সিলড উইথ কার্গো, মানে এগুলো মালপত্র বোঝাই।”

তিনিও বলেন যে কন্টেইনারে কী আছে, তা কেবল এজেন্ট এবং কাস্টমস জানবে।

তবে তিনি এও জানান, “কন্টেইনারে সাধারণত ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি থেকে শুরু করে ইকুইপমেন্ট, সব আসে। এখানে কোনও রেস্ট্রিকশনস নাই। শুধু কন্টেইনারের সাইজে রেস্ট্রিকশনস আছে।”

জানা গেছে, এই পণ্যবাহী জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে প্রথমে করাচি গিয়েছিলো। তারপর তা বাংলাদেশে এসেছে। এরপরে ইন্দোনেশিয়া যাবে।

এই সার্ভিসটি চালু করেছে দুবাই ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফিডার লাইনস ডিএমসিসি। বাংলাদেশে তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসাবে যুক্ত রয়েছে কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিজেন্সি লাইনস লিমিটেড।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, “দুবাই থেকে চট্টগ্রাম, এই সার্ভিস আমাদের আগে থেকেই আছে। এইবার আসার সময় তারা করাচি বন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসছে। স্বাধীনতার পরে সরাসরি এভাবে কোনও জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে কি না, তা জানি না। আমার জানামতে, এইবার সরাসরি এসেছে।”

“পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য আগে থেকেই ছিলো। আগে পাকিস্তান থেকে যে কন্টেইনার আসতো, তার কিছু আসতো সিঙ্গাপুর হয়ে, কিছু আসতো কলম্বো হয়ে,” যোগ করেন তিনি।

করাচি থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৬১২ নটিক্যাল মাইল। কিন্তু একটি জাহাজে যত কন্টেইনার বহন করা হয়, তত কন্টেইনার করাচি থেকে বাংলাদেশে আসে না। ফলে নতুন সেবা চালু করা প্রতিষ্ঠান ফিডার লাইনস ডিএমসিসি আরো কয়েকটি দেশের বন্দরকে এর সাথে যুক্ত করেছে।

এসব জাহাজ দুবাই থেকে পাকিস্তানের করাচি হয়ে, ভারতের মুন্দ্র হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে। আবার এখান থেকে মালয়েশিয়ার কেলাং এবং ইন্দোনেশিয়ার বেলাওয়ানে চলে যাবে।

এর ফলে আগে তৃতীয় দেশ হয়ে পণ্য আনা-নেয়ায় যে বাড়তি খরচ হতো ও অতিরিক্ত সময় লাগতো, সেটা আর লাগবে না।

সরাসরি পণ্য আসলে কী হবে?
পাকিস্তানের সাথে ব্যবসায়িক কারণে জড়িত, এমন কয়েকজন বাংলাদেশির সাথে কথা বলেছে বিবিসি উর্দু। তারা পোশাক, ফাইবার, গয়না, এমনকি প্রসাধানীও আমদানি-রপ্তানি করেন।

তেমনই একজন হলেন সৌম্য সামু। তিনি বলেন, “দুই দেশের মধ্যে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ ছিল না। এটি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের একটি বড় সমস্যা ছিল। পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করার ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যেত এবং আরেকটি বড় সমস্যা ছিল সময়।”

“বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পণ্য পাঠাতে বা পাকিস্তান থেকে পণ্য আনতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগতো। কখনও কখনও এমনও হতো যে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে পারত না। যেমন, কোনও এক ঈদের সময় পাকিস্তান থেকে অর্ডার করা পণ্য সময়মতো আসেনি,” বিবিসি উর্দুকে বলেন তিনি।

এখন এই পণ্যবাহী জাহাজের মাধ্যমে পণ্য ১০ দিনের মাঝে বাংলাদেশে পৌঁছে যাবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “যদি এইভাবে সামুদ্রিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়, তাহলে আমি পাকিস্তান থেকে আরও পণ্য অর্ডার করব। আমি আমার পাকিস্তানি ব্যবসায়ী বন্ধুদেরও জানিয়েছি।”

বাংলাদেশের গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী সৈয়দ নবীদ শাহ বলেন, “বাংলাদেশের পাকিস্তানের অনেক পণ্যের প্রয়োজন হয়। এই পণ্যগুলো আগে অন্য রুট দিয়ে আসতো।”

“সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ না থাকায় পাকিস্তান থেকে পণ্য আসতে সময় লাগতো। এতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হতো। এখন করাচি থেকে চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যেই পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে।”

ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরীও এ প্রসঙ্গে বলেন, “এভাবে পণ্য আসাটা বাংলাদেশের জন্য ভালো। এখানে খারাপ কিছু নাই। আমরা যদি সস্তায় মালামাল পাই, তাহলে তো ভালোই।”

“যে কোনও দেশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ হল সবচেয়ে সস্তা প্রক্রিয়া। অন্য দেশ হয়ে এলে সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরও কয়েকটি বন্দর ঘোরা মানে প্রতিদিনের জন্য টাকা গোণা।”

সরাসরি জাহাজ চললে সময় কম লাগবে এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম সহজ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পাকিস্তানের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ১৭ হাজার কন্টেইনার এসেছে। আর এ বছরের ৩১শে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১৬ হাজার কন্টেইনার পাঠানো হয়েছে।

তবে, এই আমদানি-রপ্তানি সরাসরি না হয়ে শ্রীলঙ্কা বা দুবাইয়ের মাধ্যমে চলছিলো।

বাংলা স্কুপ/ডেস্ক/এসকে

 
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ